হাদিস
সিহাহ সিত্তাহ বা বিশুদ্ধ ছয়টি হাদিসগ্রন্থের কোনো কোনো হাদিসে এই রাতের বিশেষত্ব নির্দেশক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থেও এই রাতের বিশেষত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়। হাদিসগুলোর সনদ বিভিন্ন মানের এবং এবিষয়ে মতভেদ বিদ্যমান। হাদিস শাস্ত্রে 'শবে বরাত' বলতে যে পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়েছে, তা হলো "নিসফ শাবান" বা "লাইলাতুন নিসফি মিন শা'বান" তথা "শা'বান মাসের মধ্য রজনী"। একটি হাদীসে বলা হয়েছে,
রসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেন, আল্লাহ মধ্য শাবানের রাতে আত্নপ্রকাশ করেন এবং মুশরিক ও হিংসুক ব্যতীত তাঁর সৃষ্টির সকলকে ক্ষমা করেন।
— (ইবনু মাজাহ, আস- সুনান ১/৪৪৫; বাযযার, আল-মুসনাদ ১/১৫৭, ২০৭, ৭/১৮৬; আহমদ ইবনু হাম্বল, আল-মুসনাদ ২/১৭৬; ইবনু আবি আসিম, আস-সুন্নাহ,পৃ ২২৩-২২৪; ইবনু হিব্বান, আস-সহীহ ১২/৪৮১; তাবরানী, আল-মুজাম আল-কাবীর, ২০/১০৮, ২২/২২৩; আল-মুজাম আল-আওসাত, ৭/৬৮; বায়হাক্বী, শু’আবুল ঈমান, ৩/৩৮১; ইবনু খুযায়মা, কিতাবুত তাওহীদ ১/৩২৫-৩২৬।)[সনদ সহীহ]
বিভিন্ন সহীহ হাদীসে বর্নিত আছে, মুহাম্মাদ (সঃ) এ মাসে বেশি বেশি নফল রোযা পালন করতেন। শাবান মাসের রোযা ছিল তার কাছে সবচেয়ে প্রিয়। এমাসের প্রথম থেকে ১৫ তারিখ পর্যন্ত এবং কখনো কখনো প্রায় পুরো শাবান মাসই তিনি নফল সিয়াম পালন করতেন। এ বিষয়ে তাকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন,
“এ মাসে রাব্বুল আলামীনের কাছে মানুষের কর্ম উঠানো হয়। আর আমি ভালবাসি যে, আমার রোযা রাখা অবস্থায় আমার আমল উঠানো হোক।”
— (নাসাঈ, আস-সুনান ৪/২০১; আলবানী, সহীহুত তারগীব ১/২৪৭।[সনদ হাসান]
হাদিস অনুসারে এই রাত দোয়া কবুল, ক্ষমা প্রার্থনা সহ আল্লাহ'র কাছে চাওয়ার রাত। যথা:
عليه وسلم : إذا كانت ليلة النصف من شعبان فقوموا ليلها وصوموا نهارها فإن الله ينـزل فيها لغروب الشمس إلى سماء الدنيا فيقول : ألا من مستغفر فأغفر له ألا من مسترزق فأرزق له ألا من مبتلى فأعافيه ألا كذا ألا كذا حتى يطلع الفجر. (رواه ابن ماجه، والبيهقي في شعب الإيمان. وهذا حديث ضعيف لأن في سنده ابن أبي سبرة وهو معروف بوضع الحديث عند المحدثين. المرجع : تحفة الأحوذي بشرح جامع الترمذي وقال ناصر الدين الألباني في هذا الحديث: إنه واه جداً)
অর্থ : আলী ইবনে আবী তালেব (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন : যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন তোমরা রাত জেগে সালাত আদায় করবে আর দিবসে সিয়াম পালন করবে। কেননা আল্লাহ তা’আলা সূর্যাস্তের পর দুনিয়ার আকাশে অবতরণ করে বলেন : আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কোন রিয্ক প্রার্থনাকারী আমি রিয্ক দান করব। আছে কি কোন বিপদে নিপতিত ব্যক্তি আমি তাকে সুস্থ্যতা দান করব। এভাবে ফজর পর্যন্ত বলা হয়ে থাকে। (ইবনে মাজাহ ও বাইহাকী)
আবূ হুরাইরা (রাঃ) বর্ণিত বুখারী ও মুসলিমের হাদীসের বক্তব্য হল আল্লাহ তা’আলা প্রতি রাতের শেষ অংশে দুনিয়ার আকাশে আসেন। আর প্রতি রাতের মধ্যে শাবান মাসের পনের তারিখের রাতও অন্তর্ভুক্ত। অতএব এ হাদীস মতে অন্যান্য রাতের মত শাবান মাসের পনের তারিখের রাতের শেষ তৃতীয়াংশে আল্লাহ তা’আলা দুনিয়ার আকাশে আসেন।
শব্দতত্ত্ব
শাবান মাসের ১৫তম রাতকে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামকরণ করা হয়। নামকরণগুলো দুটি বিষয়ের ভিত্তিতে হয়ে থাকে:
১.মধ্য শাবান বা অর্ধ শাবান, ইসলামী দিনপঞ্জির অষ্টম মাস শাবান মাসে দিনটির অবস্থান অনুসারে নামকরণ।
ইরান ও আফগানিস্তানে নিম শা'বান।
আরবী ভাষাভাষীগণ বলেন নিসফ্ শা'বান।
মালয় ভাষাভাষীগণ বলেন নিসফু শা'বান; ইত্যাদি।
২.বরাতের রাত, ফার্সিতে বরাত শব্দের অর্থ হল ভাগ্য, বণ্টন, নির্ধারিত।
লাইলাতুন নিফসি মিন শা'বান
লাইলাতুল দোয়া।
তুর্কি ভাষাভাষীগণ বলেন বিরাত কান্দিলি।
ভারতীয় উপমহাদেশে বলা হয় শবে বরাত, নিসফু শাবান ইত্যাদি।
বাংলাদেশে হালুয়া-রুটির প্রচলন যেভাবে—
শবেবরাতের অন্যতম অনুষঙ্গ হালুয়া-রুটি। ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসির মামুন তার গবেষণায় জানাচ্ছেন, ১৯শ শতকের শেষের দিকে ঢাকার নবাবরা বেশ ঘটা করেই শবেবরাত পালন করতেন, সে সময়ে ঢাকার নবাবরা শবেবরাতের আলোকসজ্জা করতেন। এরপর পাশাপাশি মিষ্টি বিতরণ করতেন। সে সময়ে যেহেতু মিষ্টির দোকান খুব একটা প্রচলিত ছিল না, সেজন্য মিষ্টি জাতীয় খাদ্য বানানোর উপাদান দিয়ে বাড়িতে হালুয়া তৈরির প্রচলন শুরু হয়। ধীরে-ধীরে এর বিস্তার ঘটতে থাকে। মূলত সে সময়ে হিন্দুদের আধিপত্য থাকার কারণে সেটিকে মোকাবেলার জন্য ঢাকার নবাবরা শবেবরাত খুব ঘটা করে আয়োজন করতেন। সেই সিলসিলা এখনো চলছে।
0 Comments